বহুমূত্র বা ডায়বেটিস রোগের লক্ষণ ও হোমিও চিকিৎসা
ডায়বেটিস থেকে জন্ম নিতে পারে অন্য নানা ধরনের রোগ। কাজেই এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। কোন কোন লক্ষণ দেখে বুঝতে পারবেন যে আপনি ডায়বেটিসে আক্রান্ত?
পৃথিবীতে ডায়েবেটিস রোগীর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। ডায়বেটিস টাইপ টু-ই বিভিন্ন ধরনের ডায়বেটিসের মধ্যে সবথেকে বেশি ছড়িয়ে পড়ছে।
কোন কোন লক্ষণ দেখে বুঝতে পারবেন আপনি ডায়বেটিস বা বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত?
- লক্ষণ রােগ ধীরে ধীরে শুরু হয়।
- তখন ঘন ঘন পিপাসা বা ঘন ঘন প্রস্রাব হইতে থাকে ।
- প্রস্রাব Bendict’s Solution (বেনডিক্টস সলুসন) দিয়া Test tube-এ ফোটালে তাহার নীল রং সবুজ, হলুদ কমলা বা লাল রং হইয়া যায় ।
- প্রচণ্ড ক্ষুধা হয়।
- রােগীর পেশী শীর্ণ হইতে থাকে, কিছু খাইলে তাহা দেহের কাজে লাগিয়া সব বাহির হইয়া যায়।
- দেহের চামড়া খসখসে হইয়া যায়।
- চুল শুকনাে ও পাতলা হইয়া যায়।
- নখ সহজেই ভাঙ্গিয়া যায়।
- ঠোট শুকনাে ও দাঁত ক্ষয়িষ্ণ হয়।
- কোষ্ঠকাঠিন্য হয়।
- রােগী বিমর্ষভাবে থাকে।
- দৃষ্টিশক্তি ও রতিশক্তি হ্রাস পাইয়া থাকে।
- অনেক সময় চুলকানি, ফোড়া ও ব্রণ প্রভৃতি হয়।
- কখনাে বা কার্বাঙ্কল হয়।
- অনেক সময় গ্যাংগ্রিন উপসর্গ হইয়া দেখা দেয়।
- রক্তে Acetone (এসিটোন) বেশী হইলে রােগী তন্দ্রাচ্ছন (মুচ্ছিত) হইয়া পড়ে, তাহাকে বলে Diabetic Coma (ডায়াবেটিক কোমা)। ইহাতেও অনেক রােগী মারা যায় । অনেক সময় এই রােগ থেকে পরবর্তীকালে যক্ষ্মা রােগ হইতে পারে।
বহুমূত্র বা ডায়বেটিসের উপসর্গঃ
১) ডায়াবেটিস কোমা (সংজ্ঞাহীনতা)।
২) ডায়াবেটিস রেটিনােপ্যাথি (কিডনীর রােগ, রক্তপাত)।
৩) ডায়াবেটি নেক্রোপ্যাথি (কিডনীর রােগ)। ৪) ডায়াবেটিক নিউরােপ্যাথিক (নার্ভের রােগ, নিউরাইটিস)।
৫) হৃদপিণ্ড ও ধমনীর রােগ।
৬) বিভিন্ন জীবাণু সংক্রামণ- যক্ষ্মা, কার্বাঙ্কল, গ্যাংগ্রিণ।
৭) ছত্রাক সংক্রামণ
ডায়বেটিসের ধরণঃ
বহুমুত্র সাধারণতঃ দুই ধরনের হয়। প্রথম প্রকার হইল কিডনীর জন্য বহুমূত্র ।
১। মধুমেহ বা ডায়াবেটিস ইনসিপিডাসঃ ইহাতে বার বার প্রস্রাব হইলে ও শর্করা জাতীয় বস্তু বা Sugar বাহির হয় না । ইহার নাম হইল ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস । অর্থ্যাৎ প্রস্রাবে শর্করা থাকিলে তাহাকে মধুমেহ বলে।
২। মূত্রমেহ বা ডায়াবেটিস স্মেলিটাস বা আসল ডায়াবেটিসঃ শর্করা না থাকিলে তাহাকে মূত্রমেহ বলে। ইহা বিশেষত্ব অলস যারা ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করে না ও মস্তিষ্ক চালকগণই এই রােগে অধিক আক্রান্ত হয়। বংশগত কারণেও এই রােগ হইতে পারে। অধিক পরিমাণে চিনি বা মিষ্টিদ্রব্য আহার অতিরিক্ত স্ত্রী সহবাস, স্নায়ুমন্ডলীতে আঘাত, অতিরিক্ত দুঃখ বা চিন্তা আরাে বহুবিধ কারণে এই রােগ জন্মিতে পারে।
বহুমূত্র বা ডায়বেটিসের চিকিৎসা
হোমিও চিকিৎসা
এসিড ফস (Acid Phos): বহুমূত্র রােগের শ্রেষ্ঠ ঔষধ। সাদা প্রস্রাব দিন অপেক্ষা রাতে বেশি। প্রবল পিপাসা দিন দিন রােগী জীর্ণ দুর্বল হইয়া পড়ে। রাত্রিতে ঘন ঘন প্রস্রাব, এসিড কসের প্রধান পরিচয়।
সেবন বিধিঃ– শক্তি 2x বা 3x ৩/৪ ফোটা সামান্য ঠান্ডা পানিসহ দিনে তিন চারবার।
এসিড এসেডিক (Acid Acetic): অত্যাধিক পিপাসা, ঘন ঘন জল পান করে সেইরূপ ঘন ঘন প্রস্রাব, ক্রমশ শরীর জীর্ণ হইতে থাকে।
সেবন বিধিঃ– শক্তি 6 বা 30 দিনে দুইমাত্রা।
সিজিজিয়াম (Syzygium Jambolanum):-পাকা কাল জামের বিচি হইতে প্রস্তুত শর্করা যুক্ত বহুমূত্র রােগের সেরা ঔষধ। অদম্য জল পিপাসা, ঘন ঘন প্রস্রাব, দিনে দিনে শরীরের ওজন কমিয়া যায়, জীর্ণ শীর্ণ দুর্বল হইয়া পড়ে। সিজিজিয়াম বহুমূত্র রােগীর ক্ষতে শ্রেষ্ঠ। ঔষধ, ইহা ব্যবহারে উপকার পাইয়াছি।
সেবন বিধিঃ– শক্তি ০ ১০/১৫ ফোটা ঔষধ অর্থ ছটাক জলের সাথে দিবসে ৩/৪ বার।
এব্রোমা আগষ্ট (Abroma Aug):—অত্যাধিক ক্ষুধা মুখ শুল্ক প্রচা বহুমূত্র পীড়ার প্রস্রাব পরিমাণে অধিক। প্রস্রাবে অনতি পরেই পিপাসা প্রস্রাবের বেগ ধারণের অক্ষমতায় ইহা ফলপ্রদ।
সেবন বিধিঃ- শক্তি Q , জলসহ দিনে ৩/৪ বার।
. ইউরিনিয়ম নাইট (Uranium Nit):—অত্যাধিক পিপাসা, অত্যন্ত ক্ষুধা, রােগী যতম ততই শুকাইয়া যায়। শর্করাযুক্ত বহুমূত্র পীড়ায় ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগে ইহা উপকারী ।
সেবন বিধিঃ– শক্তি lx, 2x বা 3x দিনে তিনবার।
সেফালে ইন্ডিকা (Cephalandra Indica): বহুমূত্র বা ডায়বেটিস পীড়ার উৎকৃষ্ট ঔষধ। সেবা শক্তি Q, ৩/৪ ফোঁটা অর্ধ ছটাক জলের সহিত দিনে ৩/৪ বার।
ক্রিয়ােজোট (Kreozote):—অত্যন্ত কোষ্ঠকাঠিন্য রােগীদের শর্করাযুক্ত বহুমূত্র প্রসy. ঘন ঘন হয় এবং প্রস্রাবের পরিমাণ অধিক। ইত্যাদি লক্ষণে ইহা উপকারী।
সেবন বিধিঃ শক্তি 30 দিনে দুইবার।
রাস এরাে (Rhus Arom): বহুমূত্র রােগে উচ্চ প্রসংশনীয় ঔষধ। প্রবল তৃষ্ণা, ঘন ঘন অধিক পরিমাণে প্রস্রাব হয়। প্রস্রাবের বেগ ধারণ করিতে পারে না। অনবরত ফোঁটা ফোঁটা করিয়া প্রস্রাব ঝরে। রােগী অতি শীঘ্র দুর্বল হইয়া পড়ে।
সেবন বিধিঃ– শক্তি Q, ১০ ফোঁটা সামান্য জলসহ দিনে তিন চারবার।।
ইনসুলিন (Insulin):—ডাঃ বােরিক এর মতে বহুমূত্র রােগের একটি উৎকৃষ্ট ঔষধ। ইহা নিয়মিত রূপে সেবন করিলে প্রস্রাবের শর্করা ভাগ কমিতে থাকে। রােগী আস্তে আস্তে সুস্থ হয়।
সেবন বিধিঃ- শক্তি 30 সকাল বিকাল দিনে দুইমাত্রা।
বাইওকেমিক চিকিৎসা
ক্যালকেরিয়া ফস (Calcaria Phos): জীর্ণ শীর্ণ ক্ষুধাহীন, দিন দিন শরীর শুকাইয়া যায়। মুখ ও জিহ্বা শুষ্ক। অত্যাধিক জল পিপাসা লবণ ও মাংস খাইতে অত্যন্ত ইচ্ছা ইত্যাদি। লক্ষণে ইহা উপকারী।
সেবন বিধিঃ – শক্তি 6x বা 12x, ২-৪ বড়ি একমাত্রা (বয়স অনুপাতে) দিনে তিনবার।।
ক্যালি ফস Kali Phos): শর্করাযুক্ত বহুমূত্র রােগে অত্যাধিক ক্ষুধা, ঘন ঘন প্রস্রাণ রােগী যখন দুর্বল হইয়া পড়ে তখন ক্যালি ফস উপকারে আসে।
সেবন বিধিঃ- শক্তি 6x বা 12x, ২-৪ বড়ি একমাত্ৰা (বয়স অনুপাতে) দিবসে তিনবার।।
নেট্রাম সালফ (Natrum Sulph): শর্করা যুক্ত বহুমূত্র। প্রস্রাবে তলানী বালুকার ন্যায়। অত্যাধিক ধুর্বলতা, ঘন ঘন ক্ষুধা, অস্থিরতা প্রভৃতি লক্ষণে ইহা উপকারী।
সেবন বিধিঃ– শক্তি 6x বা 12x ২-৪ বড়ি একমাত্ৰা (বয়স অনুপাতে) দিবসে তিনবার।
নেট্রাম মিউর (Natrum Mur):– শর্করাবিহীন বহুমূত্র। অত্যাধিক জল পিপাসা, ঘন ঘন প্রস্রাব। প্রস্রাব রাতে বেশি। সেবন বিধিঃ – শক্তি 12x বা 30x ২-৪ বড়ি একমাত্ৰা (বয়স অনুপাতে) দিবসে তিনবার।
বহুমুত্র বা ডায়বেটিস রোগে পথ্য ও আনুষাঙ্গিক ব্যবস্থা
প্রতিদিন নিয়মিত ব্যায়াম করা, প্রত্যহ ভ্রমণ করা উচিৎ। আহারের উপর এই রােগ অনেকটা নির্ভর করে। শর্করাযুক্ত খাদ্য একেবারে পরিত্যাগ করিতে হইবে। ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। চিনি বা কোনরূপ মিষ্টিদ্রব্য ও আলু আহার করা নিষিদ্ধ। নতুন চাউলের ভাত, অধিক মিষ্টি ফল খাওয়া পরিত্যাগ করিতে হইবে। প্রত্যহ কিছু টক জাতীয় ফল খাওয়া ভাল। আটাররুটি, পাউরুটি, মাখন তােলা দুধ, মাছ, মাংস, ডিম, অল্প করে খাওয়া উচিত। ডাল সাক-সবৃজি তরিতরকারি বেশি করে খাওয়া যেতে পারে। জল প্রচুর পরিমাণে পান করিবে। ভাত মধ্যাহ্ন কালে একবেলা যত কম খাওয়া যায় ততই ভাল। বহুমূত্র রােগ প্রায় একবারে আরােগ্য হয় না। ইহা আজীবনের রােগ।